অশ্লীলতা - ছোট্ট একটু ব্যবচ্ছেদ ❑ পর্ব - ৩

0

অশ্লীলতা - ছোট্ট একটু ব্যবচ্ছেদ

পর্ব - ৩

সাহিত্যের ভাষা প্রয়োগে বয়সের ব্যবধান, মা,খালা, বোন, বাবা, দাদা, বস কিছুই অন্তরায় হতে পারে না। সাহিত্য চর্চার ক্ষেত্রে এমন রক্ষণশীলতার সুযোগ নেই। গায়ের মানুষটি যখন শুদ্ধ ভাষায় কথা বলবে, যখন একটি মানুষও তার জীবন চলায় চুতমারানি, মাগি, চুদিরভাই, বাল, হোগা মারছে, কাম সারছে জাতীয় শব্দ উচ্চারণ করবে না, তখনই এধরণের শব্দ ব্যবহারকে অশ্লীলতা বলা যেতে পারে। তার আগে কেউ একে অশ্লীল বলেন, লজ্জাবোধ, বিব্রতবোধ করলে তবে তিনি সাহিত্যের জন্য নন। সাহিত্যের আলোচনায় তার অংশগ্রহণের যোগ্যতাই নেই।

সম্প্রতি একটা কবিতা লিখেছি 'মহাস্বাদিষ্ট জীবন' নামে। কবিতাটি আমার টাইমলাইনেও পোস্ট করেছি। অনেকের মন্তব্য পড়ে মনে হয়েছে তাদের খারাপ লাগেনি। কিন্তু বিপত্তি শুরু হলো, কয়েকজনকে যখন এ কবিতার দু-তিনটি শব্দ ঘুম হারাম করে দিল। সে নিয়ে অনেক আলোচনা- সমালোচনা, কাদা ছোঁড়াছুঁড়িও হলো। শেষমেষ তারা সিদ্ধান্তে উপনীত হলেন কবিতাটি অশ্লীল।

#মহাস্বাদিষ্ট_জীবন

স্বাদের জীবন, সাদীর জীবন

আহা রে, ইস্, উহু উহু রে, ওহো রে জীবন

আসামী চুদিরভাইয়ে পা তুলে পায়ে মহাসস্তায় খায়

টসটসে রসেল জমকালো জামিনভোগ, মিঠা চমচম

সাধুর পাতে দন্ডভোগ মিহিগুড়া সাজাদানা

রক্ষক রুচি ভাপে তাপা, মুড়ি বুরিন্দা, মাখামাখা আলু কা দম

মামু হবে নাকি? হয়ে যাক। হুজুরে দেখি নিমরাজী

ইয়ে মানে, ইয়ে; জানি বটে! ইয়ে জানি আরকি

দিয়ে দেবেন। দেবেনই, দেবেন দিয়েই ইজাজত!

হোগা মারছে! কাম সারছে! কি করি, কি করি

পাঠা পাঠা চটজলদি, নইলে হবেই কিন্তু কিয়ামত

রডে বিঁধে ঝুলা তাড়াতাড়ি, ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে পুড়া

কিছুক্ষণ পর পাবি না রে বাবা দম নেবারই ফুরসত।

মিশ্রীভোগ করে সাবাড় বড়ো বড়ো রাজ-রাজড়া

হুকাটা আন, তামুক বানা, বেটা বজরা সাজা

মাস্তি মহান, আহা মজা, লুটো হে মজা

গোপালের ভোগ চাও, খেটে খাও

কে আছিস ওরে, বাজা বাজনা বাজা

শিক্ষার বিনিময়ে খাদ্য, জমিনের বিনিময়ে ঋণ

চল্ তবে গলাখুলে পড়ি সবে সমস্বরে অ-তে অজগরটি আসছে তেড়ে

চল্ গুনতে শিখেই ফেলি এক দুই তিন

আহ্ হা আহা হা, স্বপ্নের স্বাদ কত না মিঠা, কী যে রঙিন!

অথচ স্বপ্ন ভঙ্গুর, কবিতা ধ্বজ, আশা ভালোবাসা খাড়ায়ে সটান

তামাতামা হবে, ভেঙ্গেচুরে হবে সব, সবকিছু হবে খানখান।

এক কবি আমাকে জানালেন, যেহেতু বয়সী কম বয়সী সব ধরণের কবি আছেন তাই এমন অশ্লীল কবিতা লিখতে নেই। আমার কথা, বয়সের ভিত্তিতে কবিদের আবার বিভাজন আছে নাকি! কবিদের বয়স, সীমানা, ভাষা ও ভাবনায় কোনো প্রকার সীমাবদ্ধতা তো থাকতে নেই। রাষ্ট্রের ক্রান্তিকালীন সময়ে সরকারকে চুদিরভাই বলে গালি দিতে না পারলে, জনগণ মুখ বুঁজে সকল প্রহসন সহ্য করার সময়ে কবি যদি লিখতেই না পারলেন—

দিনে-রাতে হোগা মারা খায় অকারণ

নাম তার জনগণ, আহা জনগণ, জনগণ!

তাহলে তিনি কিসের কবি! সুলতান সাহেব জানালেন 'চুদিরভাই' আর 'হোগা মারছে' শব্দের ব্যবহার তাদের মাথা লজ্জায় নত করে দিয়েছে! মা বোনরা একজন আরেকজনের দিকে তাকাতেই শরম পাচ্ছেন, পড়া তো দূরেই থাকল! ছি ছি কি শরমের কথা!

আমার যুক্তি হলো, শব্দগুলো কি মঙ্গল গ্রহ থেকে আমদানি করা হয়েছে! নাকি সেগুলো আমার, আমাদের প্রতিদিনের শব্দ, চারপাশের শুনতে পাওয়া শব্দ, নিত্যকার ব্যবহার্য। এগুলোর ব্যবহার কারো কাছে যদি অশ্লীলতা ঠেকে, পড়তে বিব্রতবোধ করেন, তবে সেটা তারই সীমাবদ্ধতা। ধরে নেয়া যেতেই পারে সাহিত্যচর্চার যোগ্যতা তিনি হারিয়েছেন অথবা সাহিত্য নিয়ে তার কোনো ধরণের অধিকার তার নেই। আপনার ভালো না লাগলে পড়বেন না, লিখবেন না কিন্তু তাকে অশ্লীল তকমা দিবেন সে অধিকার কি আপনার আছে! আমি মনে করি লেখালেখি শুধু নয়, তাদের সাহিত্য পাঠকেও কঠোরভাবে নিষিদ্ধ করা উচিত। শিল্প সাহিত্যের গ্রুপে তারা সদস্য হয়ে পরিবেশকে দূষিত করা, কোনোমতে প্রশ্রয় দেওয়া উচিত নয়।

কবি তার কবিতায় শব্দের খেলা খেলবেন এটাই স্বাভাবিক। সাহিত্যে শব্দ নির্বাচনের নির্দিষ্ট কোন মানদন্ড নেই, গল্প কবিতাকে কোন কাঠামোর মধ্যে সীমাবদ্ধ করাও যায় না। শিল্পী স্বাধীনভাবে শিল্প সৃষ্টি করবেন, শিল্পের মাঝে শ্লীলতা-অশ্লীলতা খোঁজার চেষ্টা করবেন গো-মূর্খরা। তবে রুচি বিবর্জিত, অর্থহীন, অশ্লীল লেখাকেও কোনোভাবে সমর্থন করা যায় না, একথাও মাথায় রাখতে হবে! কেউ শুধু শারীরবৃত্তীয় মনোরঞ্জনের জন্য যাচ্ছে তাই লিখবেন— স্তন, যোনি, নিতম্ব, ধোন, হস্তমৈথুন জাতীয় শব্দ লিখে সেটাকে সাহিত্য হিসেনে দাবি করবেন, সেটা বিকৃতি ছাড়া আর কিছুই নয়।

সেজন্যই অশ্লীলতা কি ও কেমন সে সম্পর্কে একটা স্পষ্ট ধারণা থাকতে হবে। বাংলা কবিতায় যেসব শব্দকে আমরা অশ্লীল বলে থাকি, তার প্রয়োগ কিন্তু নতুন নয়। চুমু খাওয়া, কিংবা প্রিয়ার ভিতরে প্রবেশ করা - এরও শিল্পীত মার্জিত রুপ হতেই পারে। পাঠককে নির্বোধ বলে, ধ্রুপদী শিল্পের দোহাই দিয়ে চটি সাহিত্য, বাংলা ভাষাকে স্খলন করবে সেটিও কোনোভাবে সমর্থনযোগ্য নয়।

চলুন একটু হাতে কলমে দেখা যাক, অশ্লীলতা কেমন হতে পারে।

হেলাল হাফিজের,

'আমিও গ্রামের পোলা, চুতমারানী গালি দিতে জানি';

হুমায়ুন আজাদের,

'অপার সৌন্দর্য্যের দেবী সারারাত চুষবে নষ্টের লিঙ্গ';

কবি মলয়ের—

'প্রচন্ড বৈদ্যুতিক ছুঁতার'

এগুলো অশ্লীল শব্দে ভরপুর কবিতা। এই কবিতাগুলিতে এ শব্দের ব্যবহার করার ফলে তা অশ্লীলতা প্রকাশ করছে কিনা সেটাই আমাদের মূল বিবেচ্য হতে হবে। অশ্লীল শব্দের মাধ্যমে যদি কেউ আঁকতে পারেন শ্লীল, সৌন্দর্য্য, জীবনবোধ, গণমুখী তবে হবে সার্থক, তবে নান্দনিক, তবেই সে সুন্দর। পাঠক সে লেখায় অশ্লীলতা না খুঁজে, খুঁজবেন নন্দন কানন।

আমার এ লেখায় কয়েকজন কবির কবিতায় অশ্লীল শব্দমালার প্রয়োগ খোঁজার চেষ্টা করব। তার মান অশ্লীলতাকে পরাজিত করে শিল্প হয়ে উঠতে পেরেছে কিনা সে বিচারে আমি যাব না, সে ভার পাঠকের উপরেই থাকবে। আমার এই লেখাটি তখনই সার্থক হবে, একজন পাঠকও যদি প্রকৃত অর্থে শ্লীল আর অশ্লীলের পার্থক্য করতে পারেন।

২০০৫ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় লাইব্রেরী চত্বরে জাতীয় কবিতা উৎসবে মঞ্চে আমন্ত্রিত কবি হিসেবে নির্মলেন্দু গুণ কবিতা আবৃত্তি করেন……আমি তোমাকে চুষি চুষি, মাছের কাঁটার মতো চুষি…….., তারপর পড়লেন ,… ঝুলে আছে মূলা, কেমনে খাব মূলা, বাতাসে ঝুলে মূলা….।

নির্মলেন্দু গুণ (১৯৪৫- ) গত শতকের ছয়ের দশকের কবি; প্রচলিতভাবে যাকে ষাটের দশক বলা হয়। সে সময়ই তিনি কবিতা লেখা আরম্ভ করেছেন তবে তাঁর প্রথম কবিতার বই বের হতে হতে সাতের দশক বা সত্তরের দশক এসে গেছে। প্রেমাংশুর রক্ত চাই (১৯৭০) নির্মলেন্দু গুণের প্রথম কাব্যগ্রন্থ এবং এ গ্রন্থ দিয়েই তিনি প্রথম ব্যাপক পরিচিতি লাভ করেন।

প্রেমাংশুর রক্ত চাই- এর পর নির্মলেন্দু গুণের প্রকাশিত হয় বহু কাব্যগ্রন্থ। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের মহানায়ক শেখ মুজিবুর রহমানকে নিয়ে রচিত শিল্পোত্তীর্ণ সর্বাধিক কবিতার রচয়িতা নির্মলেন্দু গুণ। এটা কম কৃতিত্বের কথা নয়। মুজিবকে নানা মাত্রায় তিনি তাঁর কবিতায় উপস্থাপন করেছেন। নির্মলেন্দু গুণ শেখ মুজিবের স্তাবক ছিলেন না বলেই তার কর্ম ও সিদ্ধান্ত নিয়ে জীবৎকালে প্রশ্ন উত্থাপন করতে দ্বিধা করেন নি :

‘মুজিব মানে আর কিছু না

এক-যমুনা রক্ত;

মুজিব মানে সমাজতন্ত্র

আমি মুজিব ভক্ত।’ – মুজিব মানে মুক্তি

এবার তাঁর অশ্লীল কবিতাগুলো নিয়ে আলোচনা করা যাক।

বাংলা সাহিত্যে শ্লীলতা অশ্লীলতা; একটি ব্যবচ্ছেদ

মেহেদী হাসান তামিম

Post a Comment

0Comments
Post a Comment (0)