অনুভব
---------------------
খেতে বসে মা বললেন,
--রাফি, বাবা তোকে একটা কথা বলার ছিল।
চুপচাপ খেয়েই যাচ্ছিল রাফি। যেন কোন এক ঘোরের মধ্যে সে। মায়ের কথা তার কানেই পৌছাল না।
এবার বাবা বললেন, তোর মা কি বলছে শুনছিস না?রাফি বলল, শুনছি তো বাবা।
তবে জবাব দিলি না যে?
একটা গল্পের থিম নিয়ে ভাবছিলাম। সরি, মা।
ইটস ওকে, বাবা।
কিন্তু তোকে বুঝতে হবে, জীবনটা গল্প নয়।
--আমি জানি মা। কিন্তু গল্প লেখা তো কোন অপরাধ নয়।
গল্প লেখা অপরাধ না হলেও মা বাবাকে কষ্ট দেয়াটা অপরাধ, নয় কি?
আমি তোমাদের কোনদিন কষ্ট দেব না, মা-বাবার মুখের দিকে তাকিয়ে স্বভাবসুলভ সরল হাসি দিয়ে বলে ওঠে রাফি। এই হাসিটাই রাফির মায়ের মনটা শীতল করার মহৌষধ। অতএব এ যাত্রা রাফিকে আর এ নিয়ে কিছু বলতে পারলেন না বেগম ফাতেমা। অসহায়ের মত চুপ করে খেয়ে চলে গেলেন বসার ঘরে।
টিভির সামনে বসে এই সময়ে তারা দুজন সময় কাটান। রাফির বাবা জনাব রাকেশ একজন সরকারি কর্মকর্তা। মা ফাতেমা বেগম উচ্চ বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেন। দুই ছেলেমেয়ে নিয়ে সুখের সংসার। মেয়েটা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করে। আর তারা দুজন
মফস্বল শহরে থাকেন। অসম্ভব মেধাবী রাফি ইংরেজি নিয়ে পড়াশোনা শেষ করে কাছেই একটা কলেজে অধ্যাপনার কাজ নিয়ে বাবা-মায়ের সাথেই থাকে। ছোটবেলা থেকে তার একটাই নেশা ছিল তা হল বই পড়া। বই ছাড়া পৃথিবীর কোন কিছুই যেন তাকে আকর্ষণ করে না। আর এজন্যই সে নির্ঝঞ্ঝাট জীবন পাওয়ার আশায় বাবা-মায়ের অনিচ্ছা সত্ত্বেও বেসরকারি কলেজে চাকরি নিয়েছে। এত মেধাবী ছেলেটা এমন সাধারণ জীবন বেছে নেবে তা তারা মেনে নিতে পারছিলেন না একদম। কিন্তু ছেলেকে সে কথা কোনভাবেই বোঝাতে পারেননি। এমনই ভোলাভালা ছেলেটা, যে কোনদিন কোন মেয়ের সাথে স্বাভাবিক বন্ধুত্বও হয়নি তার। অথচ দেখতে শুনতেও সে বেশ ভাল। শুধু কথা বলে কম।
রাফি এক শান্ত স্বভাবের ছেলে। কি তার জীবনের লক্ষ্য তা কারো জানার উপায় নেই। চাকরির অবসরে দিনরাত বইয়ে মুখ বুজে পড়ে থাকা নয়তো লেখালেখি করা এই তার জীবন। আর এমন নিরিবিলি জীবনই তার পছন্দ।
নিঃশব্দ নিস্তরঙ্গ জীবন নিয়ে তার দিনগুলো ভালই কাটতে থাকে সাথে সাথে দিনদিন বাবা-মায়ের উৎকন্ঠাও বাড়তে থাকে।
---এই ছেলের হবেটা কি? জীবনে তার কোনরকম পরিনতি কি আসবে না? সারাক্ষণ ভেবে ভেবে কোন কূলকিনারা পায়না ফাতেমা বেগম।
মেয়ে কিরণ আবার রাফির ঠিক বিপরীত চরিত্রের। দিনরাত হৈ চৈ করবে, রাগ করবে, বায়না করবে। যে কয়দিন সে বাড়িতে থাকবে বাড়িটা ঝলমল করবে। তাই কিরণ চলে যেতেই পুরো বাড়ি কেমন ঝিমিয়ে পড়ে। ফাতেমা বেগম মনে মনে ভাবেন, এবারের ছুটিতে মেয়েটা বাড়িতে এলে ওকে দিয়েই রাফিকে রাজি করাবে বিয়ের জন্য। একমাত্র আদরের বোনের কথা রাফি অগ্রাহ্য করতে পারবে না।
এমন সাত পাঁচ ভাবেন আর মেয়ের ছুটি হবার অপেক্ষা করেন তিনি। একের পর এক মেয়ে দেখতে থাকেন ছেলের জন্য। চেহারা সুন্দর হয় তো গলার স্বরটা একটু মোটা। নয়তো এমন হয় সবকিছু সুন্দর কিন্তু মেয়ে ছাত্রী হিসেবে সুবিধার নয়। ভাবেন ছেলের পছন্দ হবে না। নিজে সে কত মেধাবী। তিনি চান রাফিকে দেখালে যেন কোন অজুহাত দেখিয়ে এড়িয়ে যেতে না পারে। তাই ছেলের জন্য সেরা মেয়ে খুঁজতে লোক লাগিয়ে দিলেন। কিন্তু জুতসই মেয়ে একটাও মিললে তো। ফাতেমা বেগমের মনে শান্তি নেই। স্বামীর কাছে সারাক্ষণ তার অভিযোগ, কেন সে একটা মনের মত মেয়ে খুঁজে দিতে পারে না।
অবশেষে অভিযোগ থেকে মুক্তি মিলে যায় রাকেশ সাহেবের। অফিসের এক অনুষ্ঠানে সব পরিবার একত্রিত হওয়ার সুবাদে পেয়ে যায় তাদের মনের মত এক মেয়েকে। অফিস কলিগ জামান সাহেবের মেয়ে অর্পা। অনুষ্ঠানে গান গেয়ে প্রতিটি মানুষের মন জয় করে সে। দেখতেও বেশ ভাল। মিষ্টি সাবলীল ব্যবহার।
বাড়িতে ফিরে রাফির মা আবদার করেন স্বামীর কাছে,
---ঐ মেয়েকে আমার ছেলের জন্য এনে দিতেই হবে। রাফির বাবা অফিসের আরেক কলিগের মাধ্যমে তাদের ইচ্ছার কথা প্রকাশ করেন। মেয়ের বাবা জানালেন মেয়ে পড়াশোনা শেষ না করে বিয়ে করতে চায় না। কিন্তু রাফির বাবা কিছুতেই ছাড়লেন না। হবু বৌমার লেখাপড়ার পূর্ণ নিশ্চয়তা দিলেন তার বাবাকে। মেয়ের বাবা-মার ছেলেকে পছন্দ হল। মেয়েও নিজের মনকে স্থির করে নিয়েছিল।
রাফির একটা ছবি মা তাকে দিয়েছিল। শান্ত, মায়াভরা চোখের এক সুদর্শন পুরুষের ছবি দেখে পছন্দ না হওয়ার উপায় নেই। অর্পার বেশ পছন্দ হল। এখনকার সময়ে এমন শান্ত, ভদ্র ছেলে পেয়ে অর্পার বাবা-মাও খুশি হলেন।
কিন্তু সমস্যা হল রাফিকে নিয়ে। সে কিছুতেই বিয়ের ঝামেলায় জড়াতে চায় না। মা তার রেগেমেগে খাওয়াদাওয়া বন্ধ করে দিলেন। ওদিকে বোনের পীড়াপীড়ি উপেক্ষা করতে না পেরে অগত্যা রাজি তাকে হতেই হল। সবাই মিলে খুশি মনে বিয়ের আয়োজন শুরু করে দিল। শুভদিনে শুভ কাজ সম্পন্ন হল। ফাতেমা বেগম এতদিনে মনে এক প্রবল শান্তি অনুভব করলেন। ঘরে একজন নতুন সদস্য আসায় সবাই খুশি। কয়েকদিনের মধ্যে বাড়ির সবার চোখের মনি হয়ে উঠল অর্পা। শুধু রাফির অনুভূতিটাই বোঝা গেল না। নিজের চাকরি, লেখালেখি নিয়ে সে এত ব্যস্ত থাকে যে ঘরের নতুন মানুষটির প্রতি তার যেন দৃষ্টিই পড়ে না। কলেজ থেকে ফেরার পরে বিকেলবেলা পড়া লেখা নিয়ে বসে যায়। অর্পা ওর আশেপাশে থাকে। চা, কফি এনে দেয়।
রাফি বলে,
---তোমার চা ও নিয়ে এসো। একসাথে খাই।
তবে কথা হয় খুবই কম। রাফি সবসময়ই কেমন যেন অন্যমনস্ক ভাব। রাতের বেলা রাফি তার স্টাডি রুমে বসেই অর্ধেক রাত কাটায়। একটা কোন রোমান্টিক কথা বলে না কখনও। শুধু স্বাভাবিক দু-চারটে কথা ছাড়া কোন কথা হয় না তাদের মধ্যে। অর্পার কেমন যেন অপমান বোধ হয়। এই মানুষটার ছবি দেখে তার মনের মধ্যে সে যে সব ছবি এঁকেছিল তার ছিটেফোটাও মিল নেই বাস্তব জীবনে। প্রথম প্রথম ভাবতো হয়তো কোনকিছু নিয়ে বেশি ব্যস্ততা রাফির, কিন্তু এতদিন পরেও সে একই রকম আছে। কোন পরিবর্তন না দেখে নিজের মনকে সে আর মানাতে পারছিল না একদম। দেখতে সে যথেষ্ট সুন্দর। তাকে দেখে রাফি একটুও রোমান্টিক কথা বলে না এটা সে একদমই মানতে পারে না। কাউকে সে এ কথা বলতেও পারে না। কত রোমান্টিক কথা লেখা আছে তার গল্প, কবিতায়। অর্পা মাঝে মাঝে পড়ে দেখে। কিন্তু বাস্তবের মানুষটার সাথে সে লেখক রাফির কোন মিল খুঁজে পায় না। ধীরে ধীরে অভিমানের পাহাড় জমতে থাকে তার মনে। একদিন সে রাফিকে বলে ---আমি মায়ের কাছে যেতে চাই।
---কেন?
---সামনে আমার অনার্স ফাইনাল পরীক্ষা। বইপত্র সব তো ওখানে। পড়াশোনা করব, পরীক্ষা দিব।
---ওহ্্... তাহলে তো যাওয়াটা জরুরি।
এত সহজে রাফি এ কথাগুলো বলল যে অর্পার মনটা আরও ভারী হয়ে উঠল। তাকে একবারও যাওয়ার ব্যাপারে না করল না রাফি, এতে তার অনেক বেশি কষ্ট লাগল।
খাবার টেবিলে আবারও কথাটা তুলল, অর্পা। রাফি সে কথায় যোগ দিয়ে বলল--
---হ্যাঁ, মা। অর্পা বলেছিল আমাকে। সামনে ওর পরীক্ষা পড়াশোনা করাটা জরুরি।
সবার কেমন মনটা বিষন্ন হয়ে গেল। অর্পাকে না যাওয়ার কথা কেউই বলল না। যেহেতু ওর বাবা-মা কে কথা দিয়েছিল পড়াশোনা ঠিক রাখা হবে। কিন্তু মেয়েটা তাদের বড় আপন হয়ে গেছে এতদিনে। শুধু রাফির মনটাই বোঝা গেল না, আদৌ সেখানে অর্পাকে নিয়ে কিছু হচ্ছে কিনা। অর্পার এখনই যাওয়ার কোন প্রয়োজন বা ইচ্ছা কোনটাই ছিল না। শুধু রাফির ওপর অভিমান থেকে সে এমনটা করল।
অর্পা চলে গেল বেশ কিছুদিন। এর মধ্যে মায়ের পীড়াপীড়িতে রাফি একদিন গিয়েছিল শ্বশুর বাড়িতে। কলেজের পথে সোজা গিয়ে সন্ধ্যার আগেই ফিরে এসেছে বাড়িতে। শ্বশুর বাড়িতে সবাই তাকে কত যত্ন করল। থাকার জন্য অনুরোধ করল তবু সে চলে এলো। মা রাফিকে কিছুক্ষণ বকাবকি করল ফিরে আসার জন্য।
--- রাফি বলে, বাড়ি ছাড়া অন্য কোথাও থাকতে আমার অস্বস্তি হয় মা, কি করব বলো?
অর্পার সাথে বাড়ির সবার ফোনে কথা হয়। বেশ স্বাভাবিক ভাবেই কথা বলে সে। কাউকে বুঝতেই দেয় না তার ভিতরের কষ্ট।
পরীক্ষা শেষ হয়ে যায় একসময়। অর্পা ফিরে আসে না। শ্বশুর শাশুড়ি তাকে ফিরে আসতে বললে সে নানান অযুহাত দেখায়। রাফিকে তার মা বলে--
---তুই গিয়ে বৌমাকে নিয়ে আয়, বাবা।
---কেন, মা? ওর যখন আসতে ইচ্ছা করবে, চলে আসবে। জোর করে আনাটা উচিত হবে না।
বাবা-মা বলে বলে ক্লান্ত অথচ রাফি নির্লিপ্ত জীবন কাটাতে থাকে। আর ওদিকে অর্পার মনটা আরও কঠিন হতে থাকে ধীরে ধীরে।
এক ছুটির দিন নিজের শোবার ঘরে বসে লিখছিল রাফি। একটা রোমান্টিক গল্প লিখতে বসে গল্পের নায়িকার রূপের বর্ণনা দিয়ে গিয়ে হঠাৎ মনে পড়ল অর্পার কথা। ওয়্যারড্রোবের ওপরে রাখা অর্পার ছবির ওপর চোখ পড়ল তার। উঠে গিয়ে ছবিটা হাতে নিল সে। কি সুন্দর লাগছে অর্পাকে! চোখ ফেরানো যায় না একদম। চোখদুটো থেকে যেন মায়া উপছে পড়ছে। এই মেয়েটা এতদিন সামনে সামনে ঘুরেছে অথচ তার চেহারাটা একবার ভাল করে দেখেওনি সে।
যেমন দেখতে তেমনি তার আচার আচরণ। ছবির অর্পাকে তার খুব আপন মনে হল হঠাৎ। প্রবল আকর্ষণ অনুভব করল সে। স্বামী-স্ত্রীর জীবন যেমন হওয়ার কথা তেমনটা তো আমাদের জীবন হয়নি। সে কারণেই কি অর্পার অভিমান হয়েছে? নিজের মনকে প্রশ্ন করতে থাকে সে। তার প্রতি কি অবিচার করে ফেলেছি আমি? নয়তো পরীক্ষা শেষ হবার পরেও কেন ফিরে এলো না সে? অর্পার ছবিটা হাতে নিয়ে ভাবনায় ডুবে গেল রাফির মন।
দুপুর গড়িয়ে যাচ্ছে, ছেলে খেতে যাচ্ছে না দেখে রাফির মা ডাকতে এলেন তাকে। এসে যা দেখলেন তাতে তার নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে কষ্ট হল। মনে মনে আনন্দও হল তার। মায়ের উপস্থিতি টের পেল না রাফি।
পিছন থেকে মা এসে ছেলের কাঁধে হাত রেখে বললেন,
---আয় খেতে আয়। তারপর কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে শ্বশুর বাড়িতে যা। দুই একদিন বেড়িয়ে বৌমাকে নিয়ে চলে আসবি।
মায়ের কথায় আজ আর কোন প্রতিউত্তর করল না রাফি। বিকেলবেলা গিয়ে উপস্থিত হল অর্পার বাড়িতে। কলিং বেলের শব্দ পেয়ে অর্পা এসে দরজা খুলল। মৃদু হেসে রাফি বলল,
---কেমন আছো, অর্পা? তাকে উত্তর দেয়ার সুযোগ না দিয়ে অর্পার হাতদুটো হাতের মধ্যে নিয়ে সে আবার বলল, আজ কিন্তু আমি তোমার বাড়িতে থাকব, তোমার কাছে।
অর্পা কিছুই বলতে পারল না। অবাক বিষ্ময়ে, মুগ্ধ নয়নে তাকিয়ে থাকল শুধু। এতদিন রাফির চোখে যে অনুভূতিটা সে দেখতে চেয়েছিল, আজ সে সেটাই দেখতে পাচ্ছে।
-----০০০----
ফরিদা ইয়াসমীন নার্গিস
২৯ জুলাই, ২০২২ খ্রীস্টাব্দ
১৪ শ্রাবণ, ১৪২৯ বঙ্গাব্দ
পিরোজপুর।
Farida Yasmin Nargis

