সজীবের জীবন কথা

0



সজীবের জীবন কথা

নূরবানু রীনা

মেদাম মেদাম মেদাম, ্যাডাম বেলী তাকায় সামনে উপবিষ্ঠ একটি ছেলের দিকে। ছেলেটির নাম হান্নান। মাথাভর্তি ছোটো ছোটো কালোচুল, গায়ের রং কালচে বর্ণের, দাঁতগুলো একটু উঁচু, শুধু গাল দুটো শিশুর চপলতায় ভরা, ভারী মিষ্টি, হেটে বেড়ায় অনেকটা লাফিয়ে হাটার মতো কারণ একটি অটিস্টিক শিশু। বয়স নয় বছর। কথা বলে অস্পষ্টভাবে। ্যাডাম হেসে বলেন, কিরে হান্নান বাবু। এতো খুশী কেন আজ? হান্নান বলে, তোমাক থুন্দর লাগিচ্চে। ( সুন্দর লাগছে)

তোমার শালিডে লালি? (তোমার শাড়ীটা একটু নেড়ে দেখব?)

্যাডাম বেলী হেসে বলেন, তাই নাকি রে? শ্রেণিকক্ষের সব শিশুরা বলে ওঠে ্যাঁ ্যাডাম। খুব সুন্দর লাগছে। তাহলে ঠিক আছে হান্নান বাবু শাড়িটা নেড়ে যাও। থপাস থপাস পায়ে এসে শাড়িটা নেড়ে বলে "কি থুন্দল নলম"( কি সুন্দর নরম)

একে একে সবাই এসে ছুঁয়ে যায় ্যাডামকে।

মিতু একটি গন্ধরাজ ফুল এনে টেবিলে রেখে লজ্জায় ছুটে পালিয়ে মুখ লুকালো। এভাবে গ্রামের পরিবেশে শহুরে মেয়ে ্যাডাম বেলীর দিনগুলো ছিলো আনন্দে মূখর।

গ্রামের বিলের ধারে প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলে বিদ্যালয়টি স্হাপিত হয়েছিলো। যে গ্রামের শিশুদের মায়েরা বেশীরভাগ সময় থাকতেন নোংরা এবং ছেঁড়া কাপড় পরিধান করে। ্যাডাম বেলী যেনো এলাকার শিশু এবং অভিভাবকদের কাছে রূপকথার এক রাজকন্যা। শিশুদের অবাক চোখ মুখ অপলকে চেয়ে থাকতো তার দিকে।

্যাডাম কর্দমাক্ত রাস্তা ঘেটে যখন বিদ্যালয়ের দৃষ্টির সীমানায় চলে আসতেন তখন, শিশুরা ছুটে এসে জড়িয়ে ধরতো তাকে। কে কার আগে ্যাডামকে ছুতে পেরেছে এটা জাহির করা ছিলো একটা বিশাল কৃতিত্ব তাদের কাছে। মায়েরাও যেনো তেমনি শিশু। তারাও ঘরের দোরে, রাস্তার ধারে, উঠোনের কোণে, স্কুলের মাঠে, বাঁশঝাড়ের আড়ালে দাঁড়িয়ে থাকতেন ্যাডামকে দেখার জন্য।

্যাডাম মনে মনে ভাবেন, " একজন শিক্ষক সমাজের আদর্শ" এটাই তার প্রমাণ। তাদের ধারণা মতে, শহরের বড়লোকের মেয়ে, বড় বাড়ির বৌ যে, গরীব মানুষের সাথে এতো আন্তরিক হতে পারে এটা ছিলো তাদের কাছে এক বিস্ময়।

্যাডাম বেলী কয়েকদিন সজীব নামের একটি শিক্ষার্থীকে অনুপস্হিত পান। ওর প্রতিবেশী শিক্ষার্থীদের কাছে জানতে পারেন, সজীব অসুস্থ

ছেলেটির বাড়ি ছিলো পাশের গ্রামে। অনেক চেষ্টা করে ছেলেটির মায়ের সাথে সাক্ষাত করেন ্যাডাম।

ছেলেটি দেখতেও ছিলো খুব সুন্দর এবং মেধাবী। মা বললেন, ছেলের যে কি হলো আপা। ঠিকমতো খায়ও না। দিন দিন শুকিয়ে যাচ্ছে। গায়ে কোনো জ্বর জারীও নাই। খালি শুয়ে থাকে।

ছেলেকে ডাক্তার দেখান। মা বলেন, ডাক্তার বলে, কিছু হয়নি। খাওয়া দাওয়া করলেই ঠিক হয়ে যাবে কিন্তু ওতো খায়না আপা।

প্রতিদিন এভাবে খবর নিতেই একদিন সজীব বিদ্যালয়ে এলো। চোখ ডেবে গিয়েছে, সার্টের উপরের বোতাম ছিড়ে যাওয়ায় বুকের হাড়গুলো বের হয়ে আছে। চেহারায় যেনো ্যাওলা ধরেছে।

্যাডাম সজীবকে কাছে ডেকে নিয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন, স্কুলে আসোনা কেনো সজীব? সবাই আসে। তুমি আসোনা। আমি প্রতিদিন তোমাকে খুঁজি। আমার ভালো লাগেনা তোমাকে না দেখলে।

সজীব চুপচাপ শুনতে থাকে। তারপর বলে, আমার কিছু ভালো লাগেনা। ওর সহপাঠীরা তখন বলে, ্যাডাম সজীব গাঁজা খায়। তাই মনে হয় ওর এমন হচ্ছে। ্যাডাম বেলী, ভয়ে কুকড়ে ওঠে। গাঁজা কোথায় পায় ? আমি নিজেওতো কোনোদিন গাঁজা দেখিনি। সজীবকে বলি, তুমি গাঁজা খাও? মাথা নেড়ে বলে ্যাঁ খাই। কোথায় পাও তুমি এটা? বলে, আমাদের ওখানে মেলা (অনেক)আছে। ্যাডাম বলেন, কে আনে এগুলো? সজীব বলে, আমাদের গ্রামে গাজার বহু গাছ আছে। ্যাডাম তখনও বিষয়টি বিশ্বাস করতে পারছেন না। কারণ এমন একটি সাধারণ মানুষের মধ্যে এমন একটি মরণঘাতি মাদকের চাষ হতে পারেনা। হয়তো বাচ্চারা ভুল কিছু বলছে।

তখন ্যাডাম বলেন, তুমি আমাকে দেখাতে পারবে ওটি? অনেক বাচ্চারা বলে, আমাদের ওখানে এগুলোর অনেক গাছ আছে। আমরা কালকে আপনাকে দেখাবো। সারারাত ছটফট করতে থাকে সে, কখন স্কুলে গিয়ে গাঁজা দেখবে। পরের দিন কয়েকজন শিশু কাগজে মুড়িয়ে গাঁজা এনে দেয় তাকে। ্যাডাম ভিষণ কৌতুহল নিয়ে খুলে দেখে জিনিসগুলো। কাঁচাগুলো সবুজ রঙের শুকনোগুলো ধনিয়ার মতো। ছোটো ছোটো গোল আকৃতির।

্যাডাম বেলী ওগুলো নিয়ে সহকারী শিক্ষকদের কাছে ছুটে গিয়ে বলেন," এগুলো কি মাদক দ্রব্য গাঁজা?" দু'জন শিক্ষক একসাথে বলেন, ্যাঁ। এগুলো মাদকদ্রব্য গাঁজা। এগুলো আপনি কোথায় পেলেন?

্যাডাম বেলী শিশুদের বলেন, তোমরা জানো এগুলো কে লাগিয়েছে? শিশুরা বলে, না ্যাডাম। আমরা তাদেরকে চিনিনা। ্যাডাম বেলী উঠে পড়ে লেগে যান এই চাষীদের ধরার জন্য। দুই হাজার এগারো সাল তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিশেষ নজরজারীতে চলছে দেশের শাসন ্যবস্হা।

্যাডাম বেলী পুলিশ কর্মকর্তার মেয়ে হবার কারণে,এই প্রশাসনের সাথে বিশেষ পরিচিত ছিলেন। ্যাবের কয়েকজন অফিসার তার বাসায় ওৎ পেতে থাকতেন অপরাধীদের ধরার জন্য। সময় এবং সুযোগের অপেক্ষায়। তাদের কাছে ্যাডাম আবদার করে বসেন, আমার শিশুদের বাঁচাতে হবে। তারা শুধু বলেন, গাঁজা চাষিদের নাম জানলে সুবিধা হতো।

্যাডাম বেলী অনেক অনুসন্ধান করে দু'জনের নাম জানতে পারেন। অফিসারগণ হঠাৎ একদিন গ্রামে আক্রমণ চালায়। দুইজন চাষিকে গ্রেফতার করেন। সাথে বিপুল পরিমাণ গাঁজার গাছ উপড়ে ফেলে দেন। পরবর্তীতে দু'জনের জেল হয়ে যায়। একজন জেল থেকে বের হবার কয়েকদিন পর মারা যায়। আরেকজন এখনো বেঁচে আছে।

্যাডাম বেলী এভাবে নিষ্পাপ অবুঝ শিশুদের জীবনকে নিরাপদে বাঁচতে সাহায্য করে চলেছেন প্রতিনিয়ত। আজও সে গ্রামের নীরিহ লোকজন জানেনা তাদের গ্রামটি কে কিভাবে মাদকমুক্ত করেছে। সে চায়না তার নামডাকে বিশ্বে অমরত্ব পাক। সে চায় শিশুরা হোক একেকটি সচেতন সৈনিক। ভবিষ্যৎ বাঁচাতে এর বিকল্প নাই।

Noorbanu Rina

Post a Comment

0Comments
Post a Comment (0)