অকালে ঝরে যাওয়া ফুল

0



অকালে ঝরে যাওয়া ফুল

ছককার সাপ্তাহিক আয়োজনে আমার সামান্য নিবেদন------

পদ্মানদীর তীর ঘেঁষা একটি গ্রামে বাস করতো সুরেশ মুন্নির পরিবার। সাত ভাইবোনের মধ্যে মুন্নি ছিলো ষষ্ঠ। অভাবের সংসার। ঠিকমত খেতে পড়তে পেত না। কিন্তু মুখটা ছিলো খুব মিষ্টি! গোলগাল চেহারা, স্বাস্থ্য ভালো। বয়স /১০ বছর হবে। সুরেশ মুন্নি ছিলো প্রায় একই বয়সী। সুরেশের বাবা ছিলেন ওঝা। সাপের বিষ নামাতেন আর বাড়িতে মনসা দেবীর পূজা করতেন। তখন গ্রামের হিন্দু মুসলমানদের মধ্যে একটা সম্প্রীতি একতা ছিলো। সবাই সবার আচার অনুষ্ঠানে দাওয়াত পেতো। সেই সুবাদে ওদের দুই পরিবারের মধ্যে একটা সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক ছিলো।ওরা একসাথে খেলাধুলা করতো,স্কুলে যেতো।

বৈশাখের এক বিকেলে নদীর তীরে বড়শী দিয়ে মাছ ধরতে ছিলো সুরেশ।অদূরেই ঘুরে ঘুরে লাকড়ি কুড়াইতেছিলো মুন্নি।নদীর পাড়ের এই জায়গাটি অন্য জায়গা থেকে ছিলো একটু বেশি উঁচু। কারণ এখানে বসতবাড়ী ছিলো। বসতভিটার অর্ধেক নদী গর্ভে বিলীন হয়ে গেছে বাকি অর্ধেক উচু পাড় হয়ে ঠায় দাঁড়িয়ে আছে। মুন্নি কয়েকবার সুরেশের কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করে কী রে, মাছ কতগুলো পেয়েছিস? সুরেশ বলে, তুই যা তো এখান থেকে! আজ মাছ উঠছেনা, এমনি মন খুব খারাপ। তারপর মুন্নি আবার লাকড়ি কুড়াতে থাকে।

নদীর উঁচু তীরে অনেকখানি জায়গা নিয়ে যে বিশাল ফাটল ধরেছিলো, ছোট মুন্নি সেটা বুঝতে পারেনি।ঘুরতে ঘুরতে যখনই সে ঐখানে গিয়ে দাঁড়ায় ঠিক তখনই বিশাল মাটির চাপড়া ভেঙ্গে পড়ে। কিছুক্ষণ পর সুরেশ তাকিয়ে দেখে মুন্নি সেখানে নেই। আশেপাশে খুঁজতে থাকে। কিন্তু কোথাও মুন্নি নেই। সুরেশ, মুন্নি কই, মুন্নি কই বলে চিৎকার করতে থাকে।দূরের অনেক লোক জড় হয় সেখানে। কারও বুঝতে বাকি থাকেনা যে মুন্নি কোথায়। তারপর কোদাল শাবল দিয়ে শুরু হয় মাটি সরানোর কাজ। কিন্তু ততক্ষণে সব শেষ! মাটির চাপড়ায় পৃষ্ট হয়ে চিরদিনের জন্য স্তব্ধ হয়ে গেছে মুন্নি।ধারালো কোদালে পিঠের বেশ কিছু অংশ কেটে যায়। সমস্ত পদ্মার তীরের আকাশে বাতাসে যেনো তীব্র হাহাকার ছড়িয়ে পড়ে।

খবর শুনে মুন্নির বাবা-মা সেখানে আসেন।মৃত্যুর সংবাদ তারা জানতেন না।মেয়ের ক্ষতবিক্ষত লাশ দেখে মুন্নির মায়ের আকাশ বিদীর্ণ করা সে চিৎকার আজও আমার অলিন্দ-নিলয়ে ঝড় তুলে। আমি তখন সপ্তম শ্রেণির ছাত্রী। যদিও নদী ভাঙ্গনের আগেই আমার বাবা অন্যত্র বাড়ি করেছিলেন। কিন্তু ছোটবেলায় মুন্নিদের বাড়িতে অনেক খেলেছি, মুন্নির সাথে দুষ্টমী করেছি। ওর এমন মর্মান্তিক মৃত্যু আমার কিশোরী মন কিছুতেই মেনে নিতে পারছিলো না। অনেকদিন দিন ঘুমাতে পারিনি, খেতে পারিনি,পড়ালেখা করতে পারিনি। আমার সমস্ত অন্তঃকরণ বেদনার নীলাভ ছায়ার যেনো ঢেকে গিয়েছিলো। আজও মনে হলে একটা দীর্ঘশ্বাস আর দুফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পড়ে অজান্তেই।

অকালে ঝরে যাওয়া ফুল

(সত্য ঘটনা অবলম্বনে লেখা

Momtaz Parvin

মমতাজ পারভীন

ফরিদপুর।

Post a Comment

0Comments
Post a Comment (0)