মানুষ
এনেছে গ্রন্থ,–গ্রন্থ আনেনি মানুষ কোনো
জিয়াউদ্দীন আহমেদ
❑
নারীনিগ্রহ যে সমাজে নিত্য
দিনের ঘটনা, যে সমাজে স্ত্রী হচ্ছে প্রায় সকল কৌতুকের প্রতিপাদ্য সেই সমাজে মা দিবসে
অন্তত একটা দিন নারীর সম্মান রক্ষার কথা ফেইসবুকে উঠে আসার কথা; কিন্তু তাও কলুষিত
হচ্ছে ধর্মান্ধ ব্যক্তিদের অশালীন মন্তব্যের জন্য। অভিনেত্রীদের ছবি সোশ্যাল মিডিয়ায়
পোস্ট হওয়া মানেই অশ্লীল মন্তব্যের ছড়াছড়ি।জয়া আহসানকে নিয়ে কুরুচিকর রসিকতা প্রায়ই
দেখা যায়।মিথিলা তাহসান দম্পতির বিবাহ বিচ্ছেদের পর কলকাতার মুভি ডিরেক্টর সৃজিত মুখার্জিকে
মিথিলার বিয়ে করার সাথে সাথে তার সকল পোস্টে সাম্প্রদায়িক অশ্লীল মন্তব্য করা শুরু
হয়।সম্প্রতি মা দিবসে বাংলাদেশের অভিনেতা চঞ্চল চৌধুরী ফেসবুক পেইজে তার মায়ের সাথে
তোলা একটা ছবি পোষ্ট করেছিলেন; মায়ের সঙ্গে চঞ্চল চৌধুরীর ‘মা’ ক্যাপশনের ছবিটি
সাম্প্রদায়িকতার রোষানলে পড়ে।এই ছবিকে উপলক্ষ করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে
তার ধর্ম নিয়ে টানাটানি শুরু হয়।ছবিতে তার মায়ের মাথায় সিঁদুর, হাতে শাঁখা-পলা দেখে
অনেকে বিস্ময় প্রকাশ করেছেন।মায়ের সিঁথিতে সিঁদুর দেখে আঁতকে উঠে তারা ভাবছেন, এমন
একজন শক্তিশালী অভিনেতা আবার হিন্দু হলো কী করে! চঞ্চল চৌধুরী বা তার মা ভিন্ন ধর্মাবলম্বী,
মুসলমান নয়, এটা কিছু লোকের সহ্য হচ্ছে না।এতদিন চঞ্চল চৌধুরীর ধর্ম পরিচয় এই লোকগুলো
আন্দাজ করতে পারেননি, তাদের ধারণা ছিলো চঞ্চল চৌধুরী মুসলমান।চঞ্চল চৌধুরীর বিরুদ্ধে
এই ছবিকে নিয়ে অসংখ্য অশালীন কটুক্তি করা হয়েছে।কটুক্তির জবাবে চঞ্চল চৌধুরী ধর্ম-বর্ণ
নির্বিশেষে সকলের প্রাথমিক পরিচয় ‘মানুষ’ বলে উল্লেখ করায় অনেকে আরও বেশী ক্ষেপে উঠেছেন,
তাদের ‘যুক্তি’ হচ্ছে, তারা ‘মানুষ’ নন, ‘মুসলমান’।
❑
আগেও ধর্মের কুসংস্কারগুলো
মানুষে মানুষে বিভেদ তৈরিতে কাজ করেছে।আগের দিনে হিন্দুদের একটু বেশী সূচীবায়ু মনে
হতো।কোন মুসলমান তাদের পিঁড়িতে বসলে ধুয়ে ফেলা হতো, হুকাতে মুসলমান টান দিলে সেই হুকার
জল ফেলে দেয়া হতো, মুসলমানদের স্পর্শে এলে গোসল করতে হতো, ‘দুষ্ট’ মুসলিম শিশুদের হাতের
ছোঁয়ায় অপবিত্র হয়ে যাওয়া মাটির কলস ভাংতে এক মুহুর্তও দেরী হতো না।অবশ্য শুধু মুসলমানদের
স্পর্শ নয়, নিজেদের মধ্যে ভয়ানক বর্ণ বৈষম্যের কারণে এক হিন্দুর রান্না আরেক হিন্দু
খেত না।তবে কুসংস্কারের জন্য ভেদাভেদ থাকলেও তা সীমাবদ্ধ থাকতো সীমিত এলাকায়, সূচীবায়ু
রোগের জন্য সাম্প্রদায়িক বিষবাস্প ছড়াতো না।হিন্দু-মুসলমানের মিলিত আনন্দেই কাটানো
দিন সুন্দর হয়ে উঠতো।এই মিলনমেলা দেখেই বাউল সম্রাট শাহ আবদুল করিম লিখেছেন, ‘আগে কী
সুন্দর দিন কাটাইতাম’।
❑
সাম্প্রতিক সময়ে পৃথিবীর
সর্বত্র কিছু মানুষ কট্টর ধর্মান্ধ হয়ে যাচ্ছে।সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এখন ধর্মের
ব্যাপক অপব্যবহার হচ্ছে, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অবাধ প্রবেশাধিকার বিভিন্ন ধর্মের
মানুষে মানুষে ভেদাভেদের দেয়াল তুলে দিচ্ছে এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের অনুকূল পরিবেশে
ধর্মান্ধতা ছড়িয়ে পড়ছে দ্রুত গতিতে।ধর্মান্ধতার আরেকটি কারণ হচ্ছে, ভোটের জন্য প্রায়
সকল রাজনৈতিক দল এবং দলীয় সরকার এদের শর্তহীনভাবে প্রশ্রয় দিয়ে যাচ্ছে।তবে সাম্প্রদায়িকতার
মুখ্য কারণ হলো, দুটি ধর্ম যখন পরষ্পর বিরোধী হয় তখন ধর্মাবলম্বীদের মধ্যে শান্তি স্থাপন
দুরূহ।গরু কৃষ্ণের বাহন বলে হিন্দুদের ধর্মীয় অনুভূতিতে যতই আঘাত লাগুক না কেন, অনেক
ধর্মাবলম্বীর নিকট তা হালাল, তাই গরু জবাই রোধ করা যাবে না; ঠিক তেমনি মুশরিকদের বিরুদ্ধে
যত বিষোদগারই করা হোক না কেন, হিন্দুরা মূর্তি পুজা করবেই, কারণ এটাই তাদের ধর্ম।ফেইসবুক
ও ইউটিউবের মাধ্যমে বিভিন্ন ধর্মের পারষ্পরিক সাংঘর্ষিক বিষয়গুলো এখন মুখ্য হয়ে
উঠায় সাম্প্রদায়িক সম্পর্ক নষ্ট হচ্ছে।
❑
পৃথিবীতে কেউই ধর্ম নিয়ে
জন্ম গ্রহণ করে না, জন্ম নেয় হিন্দু পরিবারে, মুসলিম পরিবারে, বৌদ্ধ পরিবারে, খ্রিস্টান
পরিবারে।মুসলিম পরিবারে জন্ম নিয়ে সাধারণত কেউ হিন্দু হয় না, হিন্দু পরিবারে জন্ম গ্রহণ
করে তেমনি কেউ মুসলমান হয় না।তাই জন্মের পর শিশুর ধর্ম সনাক্তে পরিবারের ধর্মীয় শিক্ষার
অবদানই স্বীকার্য, জন্ম নয়।এক সময় ছিলো যখন লোকেরা নিজেদের ধর্ম ত্যাগ করে দলে দলে
নতুন ধর্ম গ্রহণ করেছে, এখন আর তেমন হয় না, এখন কালেভদ্রে দুয়েকজন ধর্মান্তরিত হলেও
ধর্মগ্রন্থ পড়ে, ধর্মের মাহাত্ম উপলব্ধি করে নতুন ধর্ম গ্রহণ করার নজির খুব বেশী নেই।যারা
ইদানীং ধর্মান্তরিত হচ্ছেন তারা নিজেদের ধর্ম সম্পর্কে সম্যকভাবে অবহিত কী না সন্দেহ,
ভিন্ন ধর্মগ্রন্থ সম্যকভাবে উপলব্ধি ও অনুধাবনপূর্বক নতুন ধর্ম গ্রহণ করার কিসসা-কাহিনী
প্রায় অবিশ্বাস্য।হিন্দু-ধর্ম সনাতন, ইহুদিরা রক্ষণশীল- এই দুই ধর্মে ধর্মান্তরিত হওয়ার
সুযোগ কম।
❑
জন্মের চেয়ে কর্মের গুরুত্ব
কম হলে গুণিজনের গুণের কদর থাকে না; কর্ম বা কৃতিত্বের চেয়ে ব্যক্তির ধর্মীয় পরিচয়
মুখ্য হয়ে উঠলে ব্যক্তির সর্বজনীন গ্রহণযোগ্যতা নষ্ট হয়।ভারতের বোম্বের সিনেমা জগতে
মুসলমান অভিনেতাদের আধিপত্য বহু যুগ ধরে অনবচ্ছিন্নভাবে অক্ষুন্ন রয়েছে, এতে অনেক মুসলমান
গর্ববোধ করেন।কিন্তু বোম্বের মুসলমান অভিনেতারা তাদের মেধা দিয়ে টিকে আছেন, মুসলমানিত্ব
দিয়ে নয়।উপমহাদেশের প্রায় সকল মুসলমান ভারতবর্ষে ইংরেজ শাসনের বিরোধী, কিন্তু ভিন্ন
দেশ থেকে আসা মুসলমান শাসকদের ভারতবর্ষ শাসনের বিরুদ্ধে তাদের কোন ক্ষোভ নেই, বরং অনেকে
মুসলিম শাসন নিয়ে গর্ববোধ করে থাকেন।অথচ মোঘল শাসক ভারতে আগমনের পথে শিখদের নির্যাতন
ও হত্যা করেছেন, ভারতবর্ষ আক্রমনকারী কিছু মুসলমান সেনানায়ক ভারতবর্ষ লুট করেছেন, এদেশের
মানুষদের নির্বিচারে হত্যাও করেছেন।সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ মুষ্টিযোদ্ধা মোহাম্মদ আলী
ক্লের মর্যাদা মুসলমানিত্বে নয়, মুষ্টিযুদ্ধে শ্রেষ্ঠত্ব অর্জনের জন্য।
❑
সাম্প্রদায়িকতার অভিশাপ
থেকে আমরা আজও মুক্ত হতে পারিনি।সাম্প্রদায়িকতার ব্যাধি দিন দিন অনিরাময়যোগ্য হয়ে উঠছে।ফেসবুকে
অনেকের চেহারা দেখতে সুন্দর মনে হলেও তাদের ভেতরটা সাম্প্রদায়িকতায় ঠাসা, ঘৃণা-বিদ্বেষে
ভরা; মানুষকে প্রথমেই তারা ধর্ম দিয়ে, বর্ণ দিয়ে, জাত দিয়ে, লিঙ্গ দিয়ে বিবেচনা করে।এরা
সুযোগ পেলেই অন্তরে লুকিয়ে রাখা সাম্প্রদায়িকতার বিষ দাঁত বের করছে।অন্ধকারে আচ্ছন্ন
তামসিক বুদ্ধি যখন মুখ্য হয়ে উঠে তখন কুযুক্তিই অপকর্মের অজুহাত হিসেবে দাঁড় করানো
হয়।তাই তো রবি ঠাকুর বলেন, ‘যে ন্যাজ বাইরের তাকে কাটা যায়, কিন্তু ভিতরের ন্যাজকে
কাটবে কে?’ লেজ বোধ হয় কখনোই কাটা যাবে না, কিন্তু নির্লজ্জের মতো যারা প্রকাশ্যে প্রশ্ন
করছে, ‘হিন্দু না ওরা মুসলিম?’ তাদের নজরুলের ভাষায় জবাব দেয়া দরকার, ‘ডুবিছে মানুষ!
সন্তান মোর মা’র!’
❑
সোশ্যাল মিডিয়া ফেইসবুক
অশালীন মন্তব্যের ভাগাড়ে পরিণত হয়ে উঠছে।কোন পোস্ট বা ভিডিও পছন্দ না হলেই কুরুচিকর
মন্তব্যের বন্যা বয়ে যায়।মানুষের ভেতরে অন্ধকার ও কদর্য দিকটির প্রকাশ ঘটে রুচিহীন,
আক্রমণাত্মক মন্তব্যের মধ্য দিয়ে।ভুয়া আইডি ব্যবহার করার সুযোগ থাকায় এমন কদর্য ভাষার
ব্যবহার সম্ভব হয়।এই রুচিহীন অশালীন মন্তব্যের সমর্থক গোষ্ঠীও রয়েছে।ধর্মীয় গোষ্ঠীর
লোকেরা ধর্মীয় গণ্ডির বাইরে কাউকে সহ্য করতে পারে না।এরা আবার কথায় কথায় ধর্মীয় মূল্যবোধের
কথা বলে থাকে।আমার এক আত্মীয়ের একটি সংবাদ পোর্টাল দেখার চেষ্টা করেছিলাম, কিন্তু সংবাদের
পাদদেশে অদ্ভুত, হাস্যকর, যুক্তিহীন, অশালীন ও অরুচিকর মন্তব্য দেখে দ্বিতীয়বার দেখার
ইচ্ছে হয়নি।এরা হুমকি দিয়ে, খিস্তি-খেউর, গালি-গালাজ ও ব্যক্তিগত আক্রমন করে বিরোধী
মতকে থামিয়ে দিতে চেষ্টা করে।এসব কুরুচিপূর্ণ মন্তব্য সমাজে গোপন বিদ্বেষ ছড়াচ্ছে,
সামাজিক মূল্যবোধ ধ্বংস করছে।
❑
হতাশার পাশাপাশি আশার কথাও
আছে, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অসংখ্য মানুষ চঞ্চল চৌধুরীর পক্ষে সোচ্চার হয়েছেন, তারা
সবাই ঘৃণার জবাবে ভালোবাসার কথা বলেছেন, নিজেদের প্রথমে ‘মানুষ’ হিসেবে পরিচয় দিয়েছেন,
প্রিয় অভিনেতার ‘মা’ ক্যাপশানের ছবিতে ভালোবাসা জানিয়েছেন।গুণি মানুষের গুণটাই মুখ্য
হোক, ধর্মপরিচয় মুখ্য হলে গুণের ধর্ম ভিত্তিক বিভাজনে আনন্দ ও অহঙ্কার কলুষিত হবে।আমাদের
জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বলেছেন, ‘মানুষের চেয়ে বড় কিছু নাই, নহে কিছু মহীয়ান’,
তিনি আরও বলেছেন, ‘মানুষ এনেছে গ্রন্থ,–গ্রন্থ আনেনি মানুষ কোনো’।চঞ্চল চৌধুরীকে যে
প্রশ্ন আজ করা হয়েছে সেই প্রশ্নের উত্তরও দিয়েছেন কাজী নজরুল, ‘হিন্দু না ওরা মুসলিম?
ওই জিজ্ঞাসে কোন জন?’ মানুষের ধর্ম দিয়ে, বর্ণ দিয়ে, জাত দিয়ে, লিঙ্গ নিয়ে যারা বিবেচনা
করেন তাদের জবাব দিয়েছেন মধ্যযুগের বৈষ্ণব পদাবলীর কবি চণ্ডীদাস, ‘সবার উপরে মানুষ
সত্য, তাহার উপরে নাই’।
❑
লেখক বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক নির্বাহী পরিচালক
ও সিকিউরিটি প্রিন্টিং কর্পোরেশনের
সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক
ahmedzeauddin0@gmail.com

