সীমাহীন ভালোবাসা

0



সীমাহীন ভালোবাসা

আজ মায়শার বিয়ে। বাবার কথা ভাবতেই চোখ দুটো জলে ভরে যাচ্ছে।

তার জীবনে বাবার অবদান যে খুব বেশি তা কিন্তু নয় ।তবুও যেন আজকের দিনটাতে বাবাকে খুব পাশে পেতে ইচ্ছে করছে।

বলতে গেলে বাবার সাথে কোন মধুর স্মৃতিই তার নেই। বাবা নামক বস্তুটা কেমন হয়ে থাকে তা তার অজানা। যেটুকু মনে পড়ে সবটাই মায়ের কাছ থেকে শোনা।

মাইশা তখন ঠিক দুমাসের। তার জন্মের পর থেকে বাবার আচরণটা পাল্টে যায় ।আদরের বাবাটা দিনে দিনে যেন রাক্ষস হয়ে ওঠে। গিলে ফেলতে চায় তাকে তার মাকে।

কারণে অকারণে নেমে আসে নির্মম অত্যাচার ।অত্যাচারের কারণটা তার মার জানা ছিল

বাবা নতুন করে নিলু আন্টির প্রতি আসক্ত হয়ে পড়েছেন এবং একথা বাড়ির সকলেই জানে। বাড়িতে তার অবাধ যাওয়া আসা

বাবা অবশ্য পছন্দ করেই মাকে বিয়ে করেছিলেন। বাড়ির কেউ বিষয়টা মেনে নিতে পারেনি। বাড়ির সবার অত্যাচারে মাকে কখনো এভাবে ভেঙে পড়তে দেখিনি।

খোদ বাবাই যখন মাকে আর রাখতে চাইছেন না তখন পায়ের নিচের মাটিটা কিভাবে শক্ত থাকে।

বাবা তো এক প্রকার আল্টিমেটাম দিয়েই দিয়েছেন।

এভাবে থাকতে পারলে থাকো নয়তো তোমার পথ তুমি বেছে নাও

তবে আমাদের মেয়েকে তুমি রেখে যেও

এভাবে থাকাটা কত যে যন্ত্রণাদায়ক তা কেবল মা জানে।

অত্যাচারের মাত্রা সহ্য করতে না পেরে সিদ্ধান্ত নিলেন পালিয়ে যাবেন। তবে মাতৃস্নেহ যে কতটা তীব্র হতে পারে তা বাড়ির লোকদের জানা ছিল না। একদিন সকালে মা মেয়ের হদিস কেউ কোথাও পেলনা।তার সন্তানকে নিয়ে তিনি পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়েছেন।

সেই থেকে শুরু হলো মা মেয়ের পথচলা ।সেলাই মেশিন চালিয়ে খেয়ে না খেয়ে মেয়েকে মানুষ করেছেন তিনি।সেই সাথে লেখাপড়াটাও। ভদ্রমহিলার শ্রম বৃথা যায়নি।

মেয়ে আজ শহরের নামকরা কলেজের লেকচারার। বিয়েটাও হচ্ছে শিক্ষা পরিবারে ইউনিভার্সিটির প্রভাষক।

মাইশা বারবার প্রশ্ন করেছে বাবার পরিচয় জানার জন্য।

--একবার শুধু বল মা সে কে? যে তোমার এতগুলো বছর নষ্ট করে দিয়েছে।

মায়ের অকাট্য যুক্তির কাছে বারবার সে হেরে গেছে। ভদ্রমহিলার একই কথা এতগুলো বছর নষ্ট হয় নি বরং তোমাকে আমি তৈরি করেছি ।মানুষের মতো মানুষ করেছি।

মাইশা আনমনে ভাবতে লাগলো--

তার মত চোখ ধাঁধানো সুন্দরীকে অনেকেই বিয়ে করতে চেয়েছেন।আমি থাকা সত্ত্বেও।

সিংহের খাবার শিয়ালে খাবে মা তা কখনো মেনে নিতে পারেনি। তার মত অভিজাত ঘরের বউদের এসবকিছু করা মানায় না।

বুকে একটা চাপা কষ্ট নিয়ে শেষমেষ বিয়েটা হয়ে গেল। মাইশা এখন পুরো দোস্তর একজন সুখি মানুষ। শাহীন অতিশয় সজ্জন ব্যক্তি।চাল-চলনে, আচার -ব্যবহারে অমায়িক মানুষ।

আজ বাইশে শ্রাবণ ১৪২৭ ।পত্রিকা খুলতেই লাবনী বেগমের চোখটা আটকে গেল ।গতরাতে ঘটে যাওয়া একটা ঘটনা পত্রিকার পাতায় ফলাও ভাবে প্রকাশিত হয়েছে ।একই পরিবারে তিন জনকে হত্যা ।খবরটা পড়তে পড়তে লাবনী পুরো দস্তর ঘেমে গেল।তার বারবার মনে হতে লাগলো সময় সবচেয়ে বেশি প্রতিশোধ নেয় শুধু ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করতে হবে। আর সময়ের কাছে তো আমরা বড্ড অসহায়। এখানে অপেক্ষা আর ধৈর্য ধরা ছাড়া কিই বা করার আছে।

বজলুর রহমান, তাঁর স্ত্রী মেয়েকে কে বা কারা খুন করেছেন।

লাবনী বেগম ফিরে গেলেন সেই ৩০ বছর আগের জীবনে। সদ্য যৌবনপ্রাপ্ত তখন। দুচোখ ভরা স্বপ্ন সুন্দর সংসারের ।আর সেই সংসারের স্বপ্ন দেখিয়েছিল 25 বছরের যুবক শাহেদ। খান পরিবারের ছেলে। আর লাবনীর সামান্য কৃষক পরিবারে জন্ম। কিন্তু দেখতে পুরো রাজকন্যা। তার কথার মোহে ফেলেছিল শাহেদ। লাবনী যে বিয়েটা করতে রাজি ছিল তা কিন্তু নয় ।বলা যায় এক প্রকার ফুসলিয়ে ঘর বাধার স্বপ্ন দেখায় যা বিলীন হয়ে যায় খান পরিবারের সংসার নামক যাঁতাকালে।

কোন কিছুই তিনি মনে করতে চান না। তবুও সব আজ জ্বলজ্বল করে চোখের সামনে ভাসছে দুর্বিসহ স্মৃতি গুলো ।কুরে কুরে খাচ্ছে তাকে।সীমাহীন দুঃখ এসে তার হৃদয়ের তটে আছড়ে পড়ছে।

তার জীবনে ঘটে যাওয়া দুঃসময় টা উঁকি দিয়ে হাসছে।

ঠিক সেই মুহূর্তে দরজার কড়া নড়ে উঠলো ।দরজা খুলতেই মাইশাকে দেখে খুব খুশি হলেন।এই দুর্দিনে তিনি মেয়েকেই পাশে চেয়েছিলেন। সেই খুশি মুহূর্তে মিলিয়ে গেল মাইশার গভীর কালো মুখটা দেখে ।এ কালো ছায়া অন্ধকারে ঢেকে দিয়েছে তার সুন্দর মুখোময়ব ।এটা দেখে তিনি ভূত দেখার মত চমকিয়ে উঠলেন ।মুখ থেকে সমস্ত রক্ত নেমে গিয়ে রক্ত শুন্য হয়ে গেল গেল।

মাকে এক প্রকার ধাক্কা দিয়ে ভেতরে ঢুকে গেল।

এক নাগাড়ে বলতে লাগলো

-- কি এমন মানুষকে বিয়ে করেছিলে যে তার পরিচয় দেওয়া যায় না?এই একটা কারণেই আমি স্কুল জীবন থেকে শুরু করে আজ অব্দি মানুষের কাছে ছোট হয়ে আসছি।

যাকে জনসম্মুখে আনতে পারবে না তাকে কেন বিয়ে করেছিলে?

তোমার মত মানুষকে বিয়ে করার জন্য ছেলের অভাব ছিল না। বরং অভাব হাওয়ার কথাও নয়। নাকি কোন জানোয়ারের ফসল আমি?

লাবনী বেগম মুখে ঠাস করে একটা থাপ্পড় মেরে কাঁপতে কাঁপতে চেয়ারে বসে পড়লেন। চোখ দুটো রক্তবর্ণ ধারণ করেছে

তাহলে শোনো---

তোমার বাবা এই শহরেরই বিশিষ্ট ব্যবসায়ী বজলুর রহমান খানের পুত্র। সম্মানী বাবার কুসন্তান বলা চলে। সমাজের যতটুকু মাথা হেয় হয়েছে তা কেবল এই গুণধন পুত্রের জন্যই। তাই আমি নতুন করে আর তাঁর মাথায় হেট হতে দিইনি।কখনো অধিকার নিয়ে জনসম্মুখে দাবি তুলিনি

--বুঝেছো?

মায়শার সমস্ত রাগ যেন গলে জল হয়ে গেল। গর্বে তার বুক ভরে উঠলো। সম্ভ্রান্ত পরিবারের সন্তান হয়েও এতদিন মাথা নিচু করে চলতে হয়েছে তাকে।

এমন সময় ঘরের দরজা খোলা থাকার কারণে একজন অপরিচিত লোক হুড়মুড় করে ঘরের ভিতরে ঢুকে পড়ল ।তার আগমনে দুজনেই আতকে উঠল ।সমস্বরে বলে উঠল--

কে আপনি?

ঘুরে দাঁড়াতেই লাবনী বেগমের চিনতে বাকি রইলো না তিনি কে।

কড়োজোরে মিনতি করে বলল তোমরা বাড়িতে চলো। আমি আমার ভুল বুঝতে পেরেছি। নিয়তি আমাকে কম শাস্তি দেয় নি। যথেষ্ট শিক্ষা হয়েছে আমার। আমাকে মাফ করে দাও ।এই দুর্দিনে আমি তোমাদের পাশে চাই।

মা মাইশা আমার কাছে আয়। এই পাপীকে তোদের সান্নিধ্য থেকে বঞ্চিত করিস না। চল মা ঘরে ফিরে চল।

এমন দৃশ্য লাবনী বেগমের কাছে স্বপ্ন মনে হতে লাগলো। তারপর তারা এক অভূতপূর্ব ভালোবাসার বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে পড়ল।

Mst Sultana

Post a Comment

0Comments
Post a Comment (0)