কিসমতের কিসমত
.........….....
জান্নাতুল মাওয়া
❑
গতবছর বৈশাখী মেলায় যেতে চাইলে মা-বাবা দু'জনেই বুঝিয়ে ঘরেই রেখেছিলো
পাঁচ বছরের ছোট্ট কিসমতকে। বলেছিলেন, "এবার মেলা নেই বাবা ঘরেই থাকি সবাই, তোমাকে
বাজার থেকে টমটম গাড়ি কিনে দেবো।" কিসমত মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানালো মা কোহিনূরকে।
চারিদিকে করোনা নামক ভয়ঙ্কর ভাইরাসের ত্রাসে সবাই যখন ঘরে থাকেন তখন
বাবা কেরামত আলী আর মা কোহিনূর ছুটে চলে হাসপাতালে তাদের কোন ছুটি নেই করোনা রোগীদের
দেখভাল করার দায়িত্ব তাদের ও আসে পর্যায়ক্রমে। দুজনেই নার্স সরকারি হাসপাতালের।ছেলেটি
থাকে দুর সম্পর্কের চাচী নুরীর কাছে। এভাবে বন্দি জীবন কিসমতের একদম ভালো লাগেনা। মা-
বাবা, "তোমাদের সাথে আমাকেও নিয়ে চলো একা একা ভালো লাগে না আমার" বলল, কিসমত।
কিন্তু তা কী সম্ভব! যেখানে নিজেদের নিরাপত্তা নেই সেখানে কিসমতকে কীভাবে নেবেন তারা।ছেলেটি
আস্তে, আস্তে নিজেকে অসহায় ভাবতে লাগলো।অবশ্য ফোনে নুরীর সাথে তাদের সবসময় কিসমতের
ব্যপারে কথা হতো।নুরী খুব ভালো। নিজের সন্তানের মতো দেখাশোনা করতো কিসমতকে।
একদিন হঠাৎ গায়ে জ্বর আর গলা খুশখুশ অনুভব করলো কোহিনূর। প্রাথমিক ওষুধ
খেয়ে যখন কাজ হচ্ছে না তখন করোনা টেষ্ট করে পজিটিভ আসলো।শুরু হলো একাকী জীবন যুদ্ধ।
অবস্থা দিন দিন খারাপের দিকে
কেরামত আলী মাথায় বাজ পড়লো যেন! এ দিকে কিসমতের মাকে দেখার কান্না ওদিকে
কোহিনূরকে বাঁচানোর প্রাণপন চেষ্টা। কাঁচের সেই ছোট্ট ঘরে একাকী লড়ছে কোহিনূর । কিসমতের
কান্না সহ্য করতে না পেরে অবশেষে নুরীকে দিয়ে হাসপাতালে আনা হলো কিসমতকে। কাঁচের ঘরে
শ্বাসের সাথে প্রাণপনে লড়ছে কোহিনূর এদিকে বাইরে কিসমতের "মা" "মা
" বলে কান্না তার কর্ণকুহরে বাজছে যেন। চোখের কোন বেয়ে নোনা বৃষ্টি ঝরছে তো ঝরছে।বাবা
কেরামত আলী নির্বাক হয়ে বসে বুকফাটা চিৎকার করছে কিন্তু কেউ শুনতে পাচ্ছে না। পুরুষ
মানুষ বলে কথা---
অবশেষে হাত পা ছেড়ে দিয়ে শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করলো সেবিকা কোহিনূর বেগম।
আকাশে বাতাসে শিশুটির কান্নার মাতম। "মা" "মাগো"
বলে মৃত মায়ের কাছে যাবার কত আকুতি কিন্তু না এ তো সর্বনাশী ভাইরাস যার ছোঁয়া আসতে
পারে ছোট্ট কিসমতের ভাগ্যে।
অবশেষে এসেই গেলো কিসমতের ভাগ্যে নতুন এক ভাইরাস যার নাম "সৎমা"-----
বাবা কেরামত আলী সংসার দেখার স্বার্থে নতুন
বিয়ে করলেন ভাবলেন একটা শান্তশিষ্ট মেয়ে ঘরে আনলে কিসমতও মা পাবে সাথে
সংসারের
হালও ধরবে।এসব সাত পাঁচ ভেবে ভেবে অবশেষে তিন মাসের মাথায় বিয়ে করে
আনলেন জরিনা নামের একটি গ্রামের মেয়েকে।
বাসর রাতেই ছোট্ট কিসমতকে তুলে দিয়ে বললেন, আজ থেকে আমার মা হারা ছোট্ট
কিসমতের সব দায়িত্ব তোমার।আমার কোন কাজ তোমাকে করতে হবে না শুধু আমার কিসমতকে সামলাবে
বলেই হাউমাউ করে কেঁদে দিলেন কেরামত আলী।জরিনা মাথা নেড়ে সম্মতি জানিয়ে ছেলেকে বুকে
তুলে নিলেন। কিন্তু না---
সবই ছিল জরিনার অভিনয়। বাবা কেরামত আলী যখন অফিসে যান তখন জরিনা কিসমতকে
কান,গাল, মাথায় টোকা মারেন জোরে জোরে। ছেলেটি ভয়ে থরথর করে কাঁপতে থাকে।বাবা যখন জরিনাকে
ফোন করে ছেলের খবর জানতে চান অফিস থেকে তখন জরিনা মধুর মধুর কথা শোনান। কেরামত আলী
তো মহা খুশি---
এদিকে কিসমতের কথাবলা, নড়াচড়া, ছুটোছুটি সবকিছুতে ব্যপক পরিবর্তন লক্ষ্য
করলেন কেরামত আলী । তার সন্দেহ হচ্ছিল কিসমত কেন জরিনার কাছে যেতে ভয় পায়?
কেন কিসমত নিজেকে গুটিয়ে নিচ্ছে? তার মুখে আর হাসি নেই কেন? ইত্যাদি
প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে থাকেন বাবা কেরামত আলী।
জরিনার ষোলকলায় বুঝতে পারেন না।কিসমত ভয়ে বাবাকে কিছু বলে না এমনিভাবে
চলতে চলতে ছোট্ট কিসমত হঠাৎ একদিন পাগলের মতো হয়ে গেল।কথা নেই, খাওয়া নেই শুধু চোখ
বেয়ে কান্নার জল।ডাক্তার দেখালো বাবা কেরামত আলী।ডাক্তার বাবু বললেন ছোট্ট ছেলেটির
উপর মানসিক চাপ এতো বেশী এসেছে বলে তার ব্রেন আর কাজ করছে না।
তার সার্বিক বিকাশ বাধাগ্রস্ত শুধু ভালবাসার অভাবে।মায়ের ভালবাসার অভাবে
কিসমতের সুন্দর আগামী হলো ধূসর রঙহীন। কিসমতের কিসমত হয়ে গেলো ডানাহীন পাখির মতো।

