গড়িয়ে পড়ে অশ্রুবিন্দু
Author -
হৃদয়ে বাংলা
July 31, 2022

পপি প্রামানিক
সম্ভ্রান্ত রায় পরিবার। বাড়ির ছোট বউ উমা দেবী। বর্ষার এক উদাস দুপুরে তাঁর কোল জুড়ে জন্ম নিলো ফুটফুটে এক কন্যা। রায় পরিবারে এই প্রজন্মের প্রথম কন্যা সন্তান। পুঁথিপত্র দেখে নাম রাখা হলো অয়ন্তি রায় ( যার অর্থ ভাগ্যবতী)।
মা মেয়েকে বুকে জড়িয়ে স্বপ্ন দেখেন একদিন আমার এই কন্যাই বিশ্ব মাঝে অনন্যা হবে। সারা বাড়িময় মেয়েটির পদচারণায় মুখরিত থাকে। সবার চোখের মণি হিসেবে রূপে লক্ষ্মী, গুণে সরস্বতী হয়ে মেয়েটি ধীরে ধীরে বড় হতে থাকে।
কিন্তু হঠাৎ একদিন অয়ন্তীর বাবা রোড এক্সিডেন্টে মারা যায়। ভাগ্যের নির্মম পরিহাসে মা মেয়ের কপালে নেমে আসে দূর্বিষহ দুঃখ। উমা দেবী মেয়েকে নিয়ে দিশেহারা অবস্থা। শুধু মাত্র একজন মানুষের অভাবেই চোখের জলের সাথেই ধুয়ে যায় সব ভালোবাসা। স্বার্থের পৃথিবীতে মানুষগুলোকে প্রকৃতভাবে চেনা যায়।
এভাবেই কেটে যায় আরও কয়েকটি বছর। অয়ন্তী পড়াশোনা করে। খুবই শান্ত স্বভাবের মেয়েটি। সামনেই এইচ, এস, সি, পরীক্ষা। সে পরীক্ষার জন্য প্রস্তুতি নিতে থাকে। কিন্তু হঠাৎ জ্বরে ভুগতে থাকে বেশ কয়েক দিন। আর এতেই শরীরটা ভীষণ দূর্বল হয়ে যায়।
অয়ন্তীর পরীক্ষা শুরু হয়ে আবার শেষও হয়ে যায়। কিন্তু আশানুরূপ পরীক্ষা দিতে না পারায় মনটা ভীষণ খারাপ তার। তাই তার মা শত বলা শর্তেও সে কোথাও বেড়াতে যায়নি। বাড়িতেই মায়ের সাথে থাকে। মাঝে মাঝেই কেমন উদাস হয়ে যায় মেয়েটি। ইদানিং তার মাও তাকে নিয়ে খুব চিন্তা করেন।
এরই মধ্যে উমা দেবীর এক আত্মীয় অয়ন্তীর বিয়ের সম্বন্ধ নিয়ে আসেন। দেখাদেখি হয় দু'পক্ষেরই। উভয় পক্ষের সম্মতিতে অয়ন্তী চৌধুরী পরিবারের বড় বউ হয়ে ঘর আলো করে আসে। স্বামী, শ্বশুর, শ্বাশুড়ি এবং একটা দেবর নিয়ে ছোট্ট সুখের সংসার তার।
অয়ন্তীর স্বামী সরকারি বড় চাকুরিজীবী। বাড়ি থেকেই আসা যাওয়া করেন। তবে ট্রেনিং বা অন্য কাজে মাঝে মাঝেই বাইরেও থাকতে হয়। শ্বশুর শাশুড়ি মেয়েটিকে নিজের মেয়ের মতোই মনে করেন। তাই ছেলেকে এক প্রকার বাধ্য করেই বউমাসহ হানিমুনে পাঠিয়ে দেয়। হঠাৎ বিয়ে হওয়ায় দু'জনের মধ্যেই বোঝাপড়ার বেশ ঘাটতি ছিল। হানিমুনটা অতি সহজেই সেই ঘাটতি পূরণ করে দেয়।
অয়ন্তীর সংসারে সুখ যেন উপচে পড়ে। ঘড়ির কাঁটায় ভর দিয়ে কেটে যায় বিয়ের দু'টি বছর। অয়ন্তী অন্তঃসত্ত্বা। কিন্তু তার স্বামী চাকুরির সুবাদে ইংল্যান্ডে অবস্থান করছে। অয়ন্তীর মা এখন তার কাছেই থাকে। অয়ন্তীর কন্যা যেদিন পৃথিবীর আলো দেখলো সেই দিন তার বরও প্রোমোশন পেলো। চৌধুরী পরিবারে যেন খুশির বন্যা বয়ে গেলো।
বর্ষার এক বিকেলে হঠাৎ স্ট্রোক করে মারা গেলেন অয়ন্তীর শ্বাশুড়ি। তার দেবর এখন দেশের বাইরে থাকে। তার শ্বশুরের শরীরটাও এখন ভালো যাচ্ছে না। এরই মধ্যে অয়ন্তী আবারও অন্তঃসত্ত্বা। কিন্তু তার স্বামীর বেশ কয়েক দিন হলো জ্বর এসেছে। অয়ন্তী বলেছে তুমি ভালো ডাক্তার দেখাও। কিন্তু তার কথা সে শোনেনি। অবশ্য সুস্থও হয়ে গেছে। অয়ন্তী এবারে পুত্র সন্তানের জননী হলো। সবাই বেশ খুশি।
অয়ন্তীর স্বামী আবারও জ্বরে আক্রান্ত হয়েছে । অয়ন্তী কেন জানি তার স্বামীর এবার জ্বর আসায় খুব অস্থির হয়ে যায়। তাই এক প্রকার জোর করে তাকে ডাক্তারের কাছে পাঠায়। ডাক্তারের পরামর্শে শারীরিক পরীক্ষা নিরীক্ষা করে জানা যায় তার স্বামী দুরারোগ্য ব্যাধি ক্যান্সারের শেষ পর্যায়ে অবস্থান করছে।
অয়ন্তীর শ্বশুর এখন শয্যাশায়ী। মূহুর্তেই চৌধুরী পরিবারে সূর্য গ্রহণের কালো ছায়া নেমে আসে। সর্বোচ্চ চিকিৎসায়ও তার স্বামীকে আর বাঁচানো সম্ভব হয় না। অয়ন্তী আকাশের দিকে তাকিয়ে ভাবে-- 'আমার নাম অয়ন্তী যার অর্থ নাকি ভাগ্যবতী'। এভাবে চোখ বন্ধ করতেই তার কপোল বেয়ে গড়িয়ে পরে উষ্ণ অশ্রুবিন্দু।