কালো মেঘ
————————————
রিয়াজ সাহেব সোনালী ব্যাংকের অবসরপ্রাপ্ত অফিসার। রিটায়ার্ড করেছেন মাত্র এক বছর।সারাজীবনের সঞ্চয় দিয়ে মফস্বলে নিজের একটি বাসা বানিয়েছেন। তিন বেডরুমের বাংলো টাইপ বাড়িটি দেখতে খুবই সুন্দর।এক ছেলে এক মেয়ে এবং স্ত্রী দীপাকে নিয়ে তিনির বাস।রিয়াজ সাহেবের পরিবার অনেক দায়িত্ব ছিল,বড় ছেলে হওয়াতে তাকে অনেক কষ্ট করতে হয়েছিল। ছোট ভাই বোনদেরকে মানুষ করা, বিয়ে দেওয়া, বৃদ্ধ মা বাবাকে দেখাশুনা করতে গিয়ে তিনি নিজের জন্য বেশি কিছু করতে পারেননি। তবু এই তৃপ্তি যে, বাবা মায়ের দোয়া পেয়েছেন, খেদমত করতে পেরেছেন।গত পাঁচ বছর আগে বাবা মা এই পৃথিবী ছেড়ে আল্লাহর ডাকে সাড়া দিয়ে চলে গেছেন। চাকুরিকালীন সময়ে মফস্বলে কম টাকায় জমি কিনেছিলেন, খুব কষ্ট করে নিজের বাড়িটি করতে পেরে মনে এক তৃপ্তি রয়েছে।বড় ছেলে ইমতি ঢাকা ভার্সিটি হতে পরিসংখ্যানে মাষ্ঠার্স করেছে। বিসিএস দিচ্ছে যদি ভাগ্যে থাকে।ইমতি ঢাকায় একটা বহুজাতিক কোম্পানীতে ম্যানেজার হিসাবে জয়েন করেছে দুমাস হল। একমাত্র মেয়ে তুলি বিবিএ পড়ছে। সুন্দর সোনার সংসারে স্ত্রী দীপার অবদান বেশিই।
রিয়াজ সাহেব ইদানীং অনেক টেনশনে আছেন, ছেলে ইমতি একটি মেয়েকে বিয়ে করে ফেলেছে।বিয়ের আগে একবার বাবা মাকে জিগ্যেস করার প্রয়োজন মনে করেনি। রিয়াজ সাহেবের চোখ বেয়ে দু'ফোটা জল গড়িয়ে পড়ল! অনেক স্বপ্ন ছিল ছেলে মেয়েকে নিয়ে। এত সুন্দর করে মানুষ করার পরও ছেলে কেন বাবা মাকে বিয়ের মত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে একবার জানাবার প্রয়োজন মনে করলনা ? অনেক আশা ছিল ছেলে প্রতিষ্ঠিত হলে বিয়ে দেবেন, বাসার পেছনের পরিত্যক্ত অংশটুকুতে কাজ করাবেন! কিন্তু সেই আশা পূরণ হলনা। ইমতি বিয়ের পর বাবা মায়ের সাথে যোগাযোগই করছেনা। রিয়াজ সাহেব খোঁজ নিতে গিয়েছিলেন! দুদিনের মাথায় ইমতির হলের বন্ধুদের সাহায়্যে ঠিকানা খুঁজে পেলেও ছেলে তাকে সোজা বলে দিয়েছে চলে যেতে। ইমতি বলেছে, আমার জীবনের সিদ্ধান্ত শুধুই আমার বাবা, আপনারা আমাকে বিরক্ত করবেননা।আমি ভালো আছি মিতুকে নিয়ে। রিয়াজ সাহেব অনুরোধ করেছিলেন, যা হবার হয়েছে বউমাকে নিয়ে বাড়ি আসো! তোমার মা অপেক্ষায় আছেন। প্রত্যেক বাবা মা চায় সন্তানদের ভালো হোক। কিন্তু ইমতি মুখের ওপর না করে দেয়, বলে মিতু যেতে চাইছেনা বাবা! বুঝার চেষ্টা করো। রিয়াজ সাহেব বলেছিলেন, তোমাকে নিয়ে অনেক স্বপ্ন ছিল বাবা! বিয়ে করে ফেলেছ ভালো কথা তুমি বাবা মায়ের প্রতি দায়িত্বে অবহেলা করতে পারোনা। তোমার জন্য তোমার মা কান্নাকাটি করছে, অনেক কষ্টে তোমাদের মানুষ করেছি। আত্মীয় স্বজন কত কথা বলার সুযোগ পাবে যদি তুমি আমাদের সাথে সম্পর্ক বিচ্ছিন্ন কর।
ইমতি বুঝিয়ে বলে, বাবা কারো কথায় আমার কিছু যায় আসেনা। যে যা ভাবে ভাবুক।মিতুর বাবা অনেক টাকার মালিক, গার্মেন্টস ব্যবসা সহ অনেক কিছু আছে।মিতু তাদের একমাত্র মেয়ে! বিয়ের শর্ত ছিল আমি ঢাকায় থাকব,মিতুকে নিয়ে একা থাকব। তুমি নিশ্চয়ই চাওনা যে , আমি অশান্তিতে থাকি। এরপর রিয়াজ সাহেবের বলার কিছু রইলনা, বিষন্ন মনে বাড়িতে ফিরে দীপাকে সব বুঝিয়ে বললেন। দীপা সব শুনে অনেক কেঁদেছিলেন।
রিয়াজ সাহেব ভাবেন কি এমন অপরাধ করেছিলাম যে, সন্তানদের মানুষ করতে পারিনি? এত চেষ্টা করেছি তাদেরকে সুশিক্ষা দিতে তাহলে আজ কেন এমন হল?
রিয়াজ সাহেবের চিন্তা বেড়েই চলে কারণ একমাত্র মেয়ে তুলিও কোন কথাই শুনেনা।
সেদিন রিয়াজ সাহেবের বন্ধু মিজান বললেন, তোর মেয়ের দিকে খেয়াল রাখিস বন্ধু! মানুষজন তোর ছেলে মেয়েকে নিয়ে অনেক কথাই বলে।
রিয়াজ সাহেবের বুক ভেংগে দীর্ঘশ্বাস বের হয়! এত যত্ন করে ছেলে মেয়েকে মানুষ করার পরেও কেন এমন হল? মেয়ে তুলি সারাদিন মোবাইলে ব্যস্ত থাকে।বন্ধুদের নিয়ে আড্ডা দেয়। কলেজে যায়, কখনো সন্ধ্যায় ফেরে! এ নিয়ে কিছু বললে রাগ করে! রিয়াজ সাহেব সেদিন নিজেকে সামলাতে না মেয়ে তর্ক করছিল বলে মেয়ের গালে থাপ্পড় দেন।অনেক শাষন করেন । কিন্তু এতে হিতে বিপরীত হল! মেয়ে তুলি দরজা বন্ধ করে নিজের রুমে বসে থাকে। দীপা ও রিয়াজ সাহেব অনেক ভয় পেয়েছিলেন! কারণ চিৎকার শুনে পাশের বাসার লোকজন চলে এসেছিল! তারা বলেছে, দেখো মেয়ে আবার সুইসাইড না করে বসে! সেই থেকে রিয়াজ সাহেব মেয়েকে কিছু বলেননা ইচ্ছার বিরুদ্ধে।ভয়ে ভয়ে থাকেন ! মান সম্মানের ভয়ে! মেয়ে যেন আরো বেশি স্বাধীনতা পেয়ে গেল। বন্ধুদের নিয়ে আড্ডা দেয় এমনকি বাসায়ও নিয়ে আসে। অসহায়ের মত রিয়াজ সাহেব ও তিনির স্ত্রী দীপা বসে থাকেন।
রিয়াজ সাহেবে মনে এতটুকু শান্তি নেই। কিভাবে যে তার ছেলে মেয়েরা এত অধঃপতনে গেল! তিনি ত সব সময় তাদের দাবী পূরণ করেছেন,ধর্ম ও নৈতিক শিক্ষা দিয়েছেন। তবু কেন ছেলে মেয়ে কথা শুনেইনা। আগে নামায পড়ত দুজন এখন ক মেয়েকে নামায পড়তে দেখেননা। নামাযের কথা বললে চুপ থাকে। ইদানীং রিয়াজ সাহেবের ঠিকমত ঘুম হয়না, প্রেশার বেড়েছে। ছেলে মেয়ের চিন্তায় তাকে নিস্তেজ করে দিচ্ছে। যে কোন বাবা মা সন্তানদের নিয়ে অনেক স্বপ্ন দেখেন কিন্তু সেই স্বপ্ন যদি পূরণ না হয় তখন কেমন লাগে? পাড়া প্রতিবেশি অনেক কথাই শুনায় ! রিয়াজ সাহেবের দিন কাটে অনিশ্চয়তা আর অস্তিরতায়! তিনি আকাশের দিকে মুখ তোলে চেয়ে থাকেন! মনে মনে বলেন , হে আল্লাহ তুমি আমার ছেলে মেয়েকে সঠিক পথে পরিচালিত করো! বাবা মা কখনো সন্তানকে দূরে ঠেলে দিতে পারেননা। তিনি বিশ্বাস করেন একদিন তার ছেলে মেয়ে নিজের মত পরিবর্তন করে বাবা মায়ের সাথে সুন্দর ব্যবহার করবে।সুপথে ফিরে আসবে।আকাশের কালো মেঘের আড়ালে সূর্যের হাতছানি থাকে।রিয়াজ সাহেব সেই সূর্যের আলোর অপেক্ষায় থাকেন।

